সাজেকে মেঘের উপরে হাটাহাটি

দার্জিলিং যাবার ইচ্ছা ছিলো অনেকদিনের (এখনো আছে), তবে দার্জিলিং এর মত মেঘের গ্রাম আছে আমাদের জানতে পারি ২০১৫ ফেব্রুয়ারীতে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে একটা চিত্র দেখাবার পর থেকে। সাজেকের ভৌগলিক অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়নও বটে। তবে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। এর পরে প্রথম আলোর নকশা এবং বিভিন্ন অনলাইন অ্যক্টিভিটি দেখে সাজেক যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়। আব্বা এবং আম্মাকে নিয়ে যাবো বলে মনস্থির করি। অক্টোবরের ২২/২৩/২৪ তিনদিন সরকারী ছুটি হবে জানতে পারি ৫অক্টোবর। ব্যাস সাজেক যাবার প্লান শুরু হয়ে গেলো। ছোট ভাই রিজভী আকরাম (রিগেলকে) প্রস্তাব দিলাম। রিগেল জানালো ওর অফিসের কলিগরা ১৫-১৬ তারিখে যাবার পরিকল্পনা করছে। আমি বললাম সবাইকে দিয়ে যাওয়া যায় কিনা।


আবশেষে মোটামুটি যাওয়া স্থির হয় এবং ওরা গাড়ি (ঈগল পরিবহন) ভাড়া করে। আমি আমার কয়েকজন কলিগদের, আমার দোস্ত হাসানকে এবং আমার ভাইরাভায়ের মেয়ে জামায়কে সাথে যাবার প্রস্তাব করি। আমরা ৪০জনের টিম সাজেক যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে আমার আব্বু আম্মু, ছোট ভাই রিগেল এবং তার স্ত্রী ও তাদের ১.৫ বছরের মেয়ে, হাসান, হাসানের স্ত্রী ও তাদের ৩ বছরের মেয়ে, হাসানের মা, হাসানের শাশুড়ি, হাসানে খালা শাশুড়ি, আমার অফিসের তিন কলিগ (শামিম, সাজ্জাদ এবং মাসুদ) এবং রিগেলের অফিস কলিগ প্লাস তাদের ফ্যামিলী ২৫ জন। তবে যাবার আগের দিন অফিসের সমস্যার কারণে ওদের অফিস কলিগ ২জন (সাথে পারিবারের ৩জন, মোট ৫জন) যেতে পারিনি।
যায়হোক নির্ধারিত ২১ তারিখ রাতে ৯:১৫টায় বাস গাবতলী থেকে রওনা হয়, আমার আব্বু আম্মু এবং ছোট ভাই রিগেলরা গাবতলী থেকে আমরা আমি এবং হাসানরা টেকনিক্যাল থেকে বাসে উঠি। আমার কলিগরা এবং মেয়ে-জামায় ওঠে কাকরাইল থেকে। এবং অবশেষে ঢাকা ত্যাগ করতে পারি রাত ১২টার পরে।
আমরা খাগড়াছড়ি শহরে সকাল ৮টায় পৌছালাম, সবাই নাস্তা করতে গেলো আর হাসান এবং কামরুল ভাইসহ চান্দের গাড়ির ড্রাইভার টিটু ভাইকে নিয়ে কেনাকাটায় গেলাম। মুরগি এবং Bar-B-Q করার আনুসাঙ্গির কেনাকাটার পরে নাস্তা সেরে চান্দের গাড়িতে সাজেকের পথে। বেলা বারোটার দিকে বাঘাইহাট থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে হাজাছড়া ঝরনা দেখতে নামলাম, ঝরনার পানিতে গোসল সেরে রওনা দিলাম সাজেকের দিকে।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে দীঘিনালার দুরত্ব ১৯ কিলোমিটার, তারপর বাঘাইহাট ১০ কিলোমিটার এবং এরপরে সাজেক পৌছাতে যেতে হবে আরো ৩৪ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে চান্দের গাড়িতে পাড়ি দিতে হলো ৬৩ কিলোমিটার। শান্তি পরিবহনের বাস অবশ্য দীঘিনালা পর্যন্ত যায়। অনান্য বাস যায় খাগড়াছড়ি পর্যন্ত।
সাজেক পৌছালাম ২:৩০ টার দিকে। নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুড়তে বের হলাম। বেড় হবার আগে আমি, হাসান এবং শরিফ ভাই মিলে Bar-B-Q করার জন্য মুরগির মাংস মেরিনেট করে রাখলাম। মুরগি জবাই দিলো আমার আব্বু। সন্ধা পর্যন্ত সাজেক ভ্যালী, হেলিপ্যাড এলাকা এবং রুইলুই পাড়াতে (লুসাই, চাকমা, পাংখোয়া, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস) ঘোরাঘুড়ি করে রাতে Bar-B-Q করতে বসলাম আমি, হাসান, সাজ্জাদ এবং শামিম। অবশ্য ছবি তোলার জন্য অনেকেই Bar-B-Q চুলার পাশে আসলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না করেই বের হলাম সাজেকের আসল রূপ দেখার জন্য। চারিদিকে মেঘ আর মেঘ। নয়নাভিরাম অরণ্যভূমি আর পাহাড়ের বন্ধনে যেখানে মেঘের দল পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা যেন মেঘের উপরে হাটাহাটি করছি। এ দৃশ্য বাংলাদেশে দেখা অনান্য দৃশ্য থেকে একেবারেই ভিন্ন। যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এমন ভাললাগা তাকেই ছুয়ে যাবে যে সাজেকে গিয়েছে। তবে বৃষ্টির সময় হলে পরিবেশটা আরো চমকপ্রদ হতো। সাজেকের সাথে বান্দরবনের নীলাচলের তুলনা করা সাজে না। সাজেকের তুলনা সজেকই। আগের সন্ধার রুইলুই পাড়া আর সকালের রুইলুই পাড়া একেবারেই ভিন্ন।
সময় সল্পতার কারনে (সকাল ১০টায় সাজেক থেকে খাগড়াছড়ি রওনা হতে হবে) কংলাংক পাড়া যাওয়া স্থগিত করা হয়েছে তারপরেও আমরা চারজন (আমি, সাজ্জাদ, হাসান এবং শামিম) কংলাংক পাড়ার দিকে রওনা হয় ৭:৩০ টার দিকে। কংলাংক পাড়া যেতে চোখে পরলো কমলার বাগান। পথে যেতে যেতে কলা আর ডিম দিয়ে নাস্তার কাজটুক সেরে নিই। কংলাংক পাড়া সাজেক থেকে বেশ উচু, আমরা পাহাড় বেয়ে উঠলাম। সেখানে মেঘ যেন পায়ে লুটিয়ে পরছে। সাজেকের তুলনায় মেঘ আরো কাছে। কংলাংক পাড়াতে চাকমা দোকানে চা খেয়ে ছবি তুলছি তখন দেখি হলেন্দ্র নামে একজন কমলা বিক্রি করতে আসছে। তার সাথে কথা বলে জানতে পারি তার বাড়ি এবং বাগান হাইস্কুল পাড়াতে (এখানে পাকিস্তান আমলে হাইস্কুল ছিলো) যেখানে যেতে আমাদের ৫ মিনিট লাগবে। আমরা তার বাগানে যাবার মন স্থির করি এবং রওনা হয়। কিন্তু আমাদের যেতে (পাহাড় বেয়ে নামতে) সময় লগলো ২০ মিনিট মত। তার বাসায় গিয়ে ঝরনার পানি খেয়ে কমলার বাগানে গেলাম। হলেন্দ্র দা কমলা তুললো আর আমরা ছবি। শেষে কমলা এবং পেঁপে কিনে সাজেকে দিকে রওনা দিলাম। কমলা এবং পেঁপে আমাদের পক্ষ্যে বহন করা সম্ভব নয় বলে হলেন্দ্র দার ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে আসলাম। পথে আসতে আমি কিছুটা অসুস্থ হয়ে যায়। অবশ্য চলার শক্তি কমে যায় বাকি তিনজনেই। আমার ছোট ভাই রিগেলকে মোবাইল করে চান্দের গাড়ি পাঠাতে বলি। রিগেল চান্দের গাড়ি নিয়ে কংলাংক পাড়ার কাছাকাছি এসে আমাদের নিয়এ যায় সাজেকে। এবং আমরা বেলা ১০:৩০টায় সাজেক পৌছায়।
বেলা ১১টায় আমরা খাগড়াছড়ির দিকে রওনা হয়। বেলা ১টায় খাগড়াছড়ি পৌছায়। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রওনা দিয় ঢাকার দিকে। পথে আলুটিলা গুহা এবং রিসাং ঝর্না দেখতে যাবার কথা থাকলেও যায় হয়নি। সুতারাং আমাদের অপূর্ণতা থেকেই যাচ্ছে।
ঢাকা আসার পথে অনেকেই কলা এবং কমলা কিনে নিয়ে আসে। ঢাকায় এসে পৌছায় রাত ১০:৩০ টায়।
সব মিলিয়ে স্বপ্নের একটা ভ্রমন সম্পূর্ণ করলাম আমরা।

### যারা যাবেন তাদের জন্য কিছু তথ্য ###

কখন যাবেন :-
শুধুই ঘুরাঘুরির জন্য হলে শীতকাল যাওয়া সবচেয়ে ভালো। আর আপনি যদি এডভেঞ্চার প্রিয় হন আর পাহাড়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য দেখতে চান তবে বর্ষাকালে যাবেন।

যেভাবে যাবেন :-
প্রথমে যেতে হবে খাগড়াছড়ি অথবা দিঘীনালা। রাজধানী থেকে শান্তি পরিবহন, বিআরটিসি (এসি বাস), সেন্ট মার্টিন (এসি বাস), শ্যামলী, সৌদিয়া, ঈগল, এস.আলম পরিবহনে খাগড়াছড়ি এবং দিঘীনালায় সরাসরি যাওয়া যায়।
ভাড়া ৫৮০ টাকা (খাগড়াছড়ি) এবং ৬০০ টাকা (দিঘীনালা)।
চট্টগ্রাম থেকে প্রতি একঘণ্টা পরপর শান্তি পরিবহনের গাড়ি ছাড়ে, ভাড়া ১৯০ টাকা। তাছাড়া চট্টগ্রামের লোকাল বাসেও যাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি অথবা দিঘীনালা থেকে ভাড়ায় চাঁদের গাড়ি, ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা, সিএনজি ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা অথবা মোটরবাইক ১০০০ থেকে ১২০০ রির্জাভ করে সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন।

যেখানে থাকবেন :-
সাজেক এলাকায় থাকার জায়গা নেই। তাই রাতে থাকার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে। দল বড় হলে প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই।
থাকার জন্য আছে,
# রুনময় রির্সোট (বিজিবি পরিচালিত), বিস্তারিত www.rock-sajek.com থেকে পারেন।
# সাজেক রির্সোট (সেনাবাহিনী পরিচালিত) এখানে থাকার জন্য সেনাবাহিনী রেফারেন্সে অন্ততঃ ১৫ দিন আগে বুকিং দিতে হবে, রুম আছে চারটি, ভাড়া ১০০০০, ১২০০০ এবং ১৫০০০ টাকা।
# আলোর রির্সোট (বুকিং এর জন্য :- Sajek: 01863606906, Head office: 01755 556699, 0371-62067
# ক্লাব হাউজ: সেমি পাকা ঘরটি মূলত ওখানকার মানুষদের জন্য ক্লাব হিসেবে করে দিয়েছিলো আর্মি, তবে পর্যটক বেশি হলে অথবা এমনিতেই কেউ থাকতে চাইলে এখানে থাকা যায়। বিছানাপত্র কেয়ারটেকারই দিবে, ভাড়া ১৫০-২০০টাকা মাথা পিছু। খাবারের ব্যাবস্থা বললে কেয়ারটেকার করে দিবে, খরচ হবে প্রতিবেলা ১৫০-২০০ টাকা।
# এছাড়া যদি নিজেরা ক্যাম্পিং করতে চান করতে পারবেন। ক্যাম্পিং করার জন্য রুইলুই পাড়ায় অনেক গুলো সুন্দর স্পট রয়েছে। তবে ক্যাম্পিং করার আগে নিরাপত্তা বাহিনীকে বলে নেবেন।

যেখানে খাবেন :-
সাজেকবাসীদের পরিচালিত কয়েকটি দোকানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সেক্ষেত্রে আগেই তাদের জানাতে হবে।

দর্শনীয় স্থান :-
# দিঘিনালা বৌদ্ধ্যমন্দির
# হাজাছড়া ঝরনা
# কংলাংক পাড়া
# হেলিপ্যাড এলাকা
# রুইলুই পাড়া
# সাজেক ভ্যালী
# আলুটিলা রহস্যময় সুড়ঙ্গ
# রিছাং ঝরনা
# তৈদুছড়া ঝরনা ১ ও ২
# সিজুক ঝরনা ১ ও ২
# দিঘিনালা বাজার
# দিঘীনালা বন বিহার
# ঝুলন্ত ব্রীজ

যা যা সঙ্গে নিবেন :-
# রবি বা টেলিটকের মোবাইল সংযোগ। (রবির কাভারেজ ভালো)
# ব্যাক্তিগত ব্যাগ (পানিরোধক হলে ভালো)
# শীতের কাপড় সহ অতিরিক্ত ২ সেট কাপড়
# তোয়ালে/গামছা
# ইনফ্লেটেবল পিলো (বাতাস বালিশ)
# বিছানার চাদর
# লাইট
# মোবাইল বা অনান্য ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের জন্য পাওয়ার ব্যাকআপ
# সান ক্যাপ / হ্যাট
# ট্র্যাকিং স্যান্ডেল / জঙ্গলবুট
# ছাতা/রেইনকোট
# হাল্কা এবং শুকনা খাবার (পাউরুটি হলে ভাল, এখানে অনেক কলা পাওয়া যায়।)
# পানির বোতল
# মশার কয়েল/মশারী
# নিজের দরকারী ঔষধ

খেয়াল করবেন :-
মানুষ প্রকৃতির কাছে যাবে, তবে প্রকৃতি যাতে তার মতো করে সুন্দর থাকে সেই দায়িত্বটাও মানুষের হাতে।
আপনার ব্যবহার কোন প্রকার পলিথিন, পানির বোতল, প্যাকেট, ময়লা ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। না হলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।

ট্যুর প্লান :-
১ম রাত: রাতের বাসে, ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি/দীঘিনালা।
১ম দিন: বাস থেকে নেমে সকালের নাস্তা সেরে খাগড়াছড়ি/দীঘিনালা থেকে সাজেক।
২য় রাত: সাজেকে অবস্থান।
২য় দিন: সকালে সাজেক ঘুরে ৯টার দিকে রওনা দিয়ে দীঘিনালা, তৈদুছড়া ১ ও ২ ঝরনা অথবা সিজুক ঝরনা ১ ও ২ অথবা আলুটিলা গুহা এবং রিছাং ঝরনা দেখে খাগড়াছড়ি।
৩য় রাত: রাতের বাসে খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা।

কিছু প্রয়োজনীয় নাম্বার :-
সাজেকের হেডম্যান :- লাল তাঙ্গা লুসাই 01552-726987
সেন্টমারটিন পরিবহন :- 01732-406352, 01762-691340
শ্যামলি পরিবহন :- 01815-273942
বিআরটিসি আরামবাগ :- 01689-928042
সৌদিয়া ফকিরারপুল :- 01919-654858
চান্দের গাড়ি (টিটু) :- 01816-038997
হলেন্দ্র (কংলাংক পাড়া কমলা বাগান মালিক) # 01557-273244

৮ Comments on "সাজেকে মেঘের উপরে হাটাহাটি"

Leave a Reply to Nusrat AfrinCancel reply

×
কপিরাইট © ২০০৬-২০২৪ সমকাল দর্পণ. সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েল টেকনোলজিস