খৈয়াছড়া ঝরনা দেখা: দুধের স্বাধ দুধেই মিটানো

খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যাবার প্রসঙ্গ তোলে দিশা ভাবি (হাসানের বউ) কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে উনাকে ছাড়ায় আমাদের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যেতে হয়। সিলেটের বিছনাকান্দি ঘুরে আসার পরে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যাবার পরিকল্পনা করি কিন্তু সময়, দূর্গম পথে পরিবার সাথে নিয়ে যাওয়া, চট্টগ্রাম রুটে খারাপ রাস্তা, সবকিছু মিলিয়ে যাবার পরিকল্পনাতে ভাটা পরে। প্রকৃতির অপূর্ব এই সৃষ্টি খৈয়াছড়া ঝরনা হচ্ছে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অর্ন্তগত যা, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলাার খৈয়াছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত।
এরই মাঝে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ হাসান আমার অফিসে আসলে দুপুরে খাবার পরে আড্ডার সময় হঠাৎই বললো, চল কালকে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যায়। আমিও বললাম চল, তবে শুধুমাত্র ছেলেরা যাবো। ব্যাস খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হলো। যেহেতু হাসানের মাইক্রোবাসে আমরা যাবো সেহেতু যেতে পারবো ৭ জন। আমার কয়েকজন সবকর্মী এবং নিকট কিছু বন্ধুদের কয়েকজনকে প্রস্তাব দিলাম কিন্তু এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বা শুক্রবারে ব্যাস্ততার করনে অনেকে যেতে পারলো না। অবশেষে আমার সহকর্মী সাজ্জাদ হোসন, শামীম-আল-মামুন এবং শাহ-নেওয়াজ রাজি হলো সাথে শাহ-নেওয়াজর দুই বন্ধু শাহিন এবং মজনু যাবে বলে নিশ্চিত করলো।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ৪ টায় ঘুম থেকে উঠলাম। মোবাইলে যোগাযোগ হলো সবার সাথে। আমি বাসা থেকে বের হলাম রাত ৪:৩০ টায়। মিরপুর ১ থেকে হাসানের সাথে কলাবাগান থেকে শাহ-নেওয়াজ, শাহিন এবং মজনুকে তুলে বাড্ডা থেকে শামীম এবং সাজ্জাদকে তুলে ঢাকা ছাড়লাম ভোর ৬ টায়। সকাল ৯ টায় আমরা কুমিল্লার হোটেল তাজমহলে নাস্তা সেরে বেলা ১২:৩০ টায় আমরা মিরসরাই পৌছালাম। মিরসরাই বাস স্টপেজ থেকে শুকনা খাবার এবং আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে রওনা দিলাম। মিরসরাই বাস স্টপেজ ২.২ কিলোমিটার সামনে বড়তাকিয়া বাজার বাস স্টপেজে যেখানে খৈয়াছড়া হাইস্কুল, সেই স্কুলের একটু আগে ঠিক বিপরীত দিকের (পূর্বদিকে) সুরু রাস্তায় যেতে হবে।
এখান থেকে খৈয়াছড়া ঝরনার দুরত্ব ৪.২ কিলোমিটার কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে রেললাইন (খৈয়াছড়া রেল বাজার) পর্যন্ত, যা এখান থেকে ১.৪ কিলোমিটার। আমরা খৈয়াছড়া রেল বাজার গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে মাইক্রো পার্কিং করে হেটে রওনা দিলাম খৈয়াছড়া ঝরনার দিকে। এখানে একটি ছোট খাবারের দোকানসহ দুটো দোকান রয়েছে, রেললাইনের ওপারে গ্রামে দুই যায়গায় দুটি ছোট খাবারের দোকান পাবেন। আমরা যাবার সময় ওয়াসিম আকরাম নামে এক টুরিষ্ট গাইড নিলাম ১৫০ টাকায় (পরে অবশ্য ৫০ টাকা বকশিশ দিয়েছি)। এখান থেকে ঝরনা পর্যন্ত ২.৮ কিলোমিটার হেটে যেতে হবে। এর মধ্যে ১.৫ কিলোমিটার গ্রামের রাস্তা বাকীটুক ঝিরিপথ বা পাহাড়ী পথে যাওয়া যাবে। গ্রামের এই রাস্তাটুকুতে অবশ্য সিএনজি অটোরিক্সা চলে ভাড়া ১০০ টাকা। আমরা গ্রামের রাস্তা শেষে ঝিরিপথে যেতে খৈয়াছড়া জামে মসজিদ পেলাম, ঝিরিপথে আসা ঝরনার পানিতে অজু করে জুম্মার নামাজ পড়লাম। এটা আমরা দেখা সবচেয়ে ছোট (মুসল্লি এবং আয়তনের দিক থেকে) জামে মসজিদ।
বাঁশের সাঁকো, ক্ষেতের আইল, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, ঝর্ণার স্বচ্ছ জলের ঝিরিপথ মিলিয়ে যাওয়ায় পথ কিছুটা কমলো। বেলা ২ টায় আমরা আকাঙ্খিত অপরুপ মাধুর্যে ভরা খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে পেলাম। টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের শরীর লেপটে। সবুজে ঘেরা পাহাড়কে মনে হয় যেন এক সবুজের অভয়ারণ্য। আর এই সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে কলকল ধ্বনিতে নেমে আসছে বুনো ঝরনা খৈয়াছড়া।
খৈয়াছড়া ঝরনার মোট আছে ৭টি স্টেপ বা বড় বড় ধাপ (কারো মনে ৮/১০টি)। বেশিরভাগ পর্যটকরই প্রথম ধাপের সৌন্দর্য দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয় কারন পাহাড়ের উঁচুতে উঠে বাকি ধাপগুলোতে যাওয়া বেশ কষ্টকর এবং ঝুকিপূর্ণ। শাহ-নেওয়াজ এবং শাহিন ব্যাতিত আমরা ৫ জন পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার পাশ দিয়ে ওপরে উঠা শুরু করলাম। ২য় ধাপের প্রথম দিকে কিছুটা (পূর্বে কারো ট্র্যাকিং করে রেখে যাওয়া) দড়ি, জংলি লতা আর শক্ত গাছের শিকড় ধরে উঠলাম। এরপরে আমি উঠবো না বলে জানালাম। বাকী ৪ জন আমাকে রেখে আবার উপরে উঠতে শুরু করলো। ৪র্থ ধাপ পর্যন্ত সাজ্জাদ উঠে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্রামে গেলো। ৬ষ্ট ধাপ পর্যন্ত গেলো শামীম, হাসান এবং মজনু। উপরের ধাপগুলোতে ওরা বেশ মজা করলো। শাহ-নেওয়াজ এবং শাহিন পরে আফসোস করছিলো তারা কেন উপরে গেলো না, আর আমার আফসোসও কম না, কষ্টে ২য় ধাপ পর্যন্ত গিয়ে আরো উপরে উঠতে না পারার। ৬ষ্ট ধাপ থেকে নিচ পর্যন্ত নামতে সময় লাগলো আধা ঘন্টার বেশী। নিজে এসে বেশ মজা করে গোসল করলাম সবাই।

বেলা ৪:৩০ টায় আমরা ফেরা শুরু করলাম তখন হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছিলো। খৈয়াছড়া রেল বাজারে এসে পোশাক পরিবর্তন করে হাল্কা কিছু খেয়ে ৬ টায় রওনা দিলাম ঢাকার পথে। বারইয়ারাঘাট বাজারে আমরা খাওয়া-দাওয়া করলাম। রাত ৯:৪৫ টায় আমরা কুমিল্লার হোটেল নুরজাহানে হাল্কা নাস্তা করলাম, আমাদের এক বন্ধু সুবুজ কুমিল্লা থাকে, তাকে আগে থেকে রসমালাই কিনে রাখতে বলেছিলাম কয়েক জনের জন্য, সে হোটেল নুরজাহানে এসে দিয়ে গেলো। রাত ২টায় পরে আমরা বাসাতে পৌছালাম।

প্রয়োজনীয় তথ্য
• ছোট সাইজের ট্রাভেল ব্যাগ নিলে হাটতে এবং পাহাড়ে ট্রাকিং করতে সুবিধা হবে।
• খৈয়াছড়া ঝরনা প্রায় পুরো এলাকাটিই বেশ পিচ্ছিল। অবশ্যই পিছনে বেল্টওয়ালা প্লাষ্টিক স্যান্ডেল বা ট্র্যাকিং স্যান্ডেল নিবেন তা নাহলে হাটতে এবং ট্র্যাকিং করতে কষ্ট হবে।
• ২/৩ টা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, ২/৩ টা টি-শার্ট, গামছা, লুঙ্গি, লোশন, চিরূনী সাথে আনবেন।
• ওয়াকিং স্টিক বা পাহাড়ে হাটার লাঠি থাকলে সুবিধা হবে (গ্রাম থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন)
• এ এলাকায় খাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই, অবশ্যই শুকনা খাবার, ফল নিয়ে যাবেন। ঝরনার পানি বিশুদ্ধ (যদি না কেউ ট্র্যাকিং করে)। তবে আগে থেকে নিশ্চিত করলে গাইড দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
• জরুরী ঔষধ সাথে নিবেন।
• বৃষ্টি থাকলে এ পথে কিছুটা জোঁকের উপদ্রব থাকে। তখন পায়ে মোজা পরে নিলে সুফল পাওয়া যাবে। সাথে লবন বা গুল নিয়ে যেতে পারেন।
• সবগুলো ধাপ দেখতে চাইলে সঙ্গে শক্ত দড়ি নেওয়া উচিত। ওঠা কিংবা নামার সময় রশির সাহায্য নিয়ে কষ্ট কম হবে। যাদের পাহাড়ে উঠার অভ্যাস নেই তাদের উপরের ধাপগুলোতে না যাওয়াই ভালো। এছাড়া পিচ্ছিল বলে ধাপগুলোর পাশে যাওয়াও ঠিক হবে না।
অনুরোধ: খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকাতে অপচনশীল জিনিসপত্র যেমন প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, কিংবা এ ধরনের যে কোনও কিছু ফেলে আসবেন না।

১৫ Comments on "খৈয়াছড়া ঝরনা দেখা: দুধের স্বাধ দুধেই মিটানো"

  1. সত্যি অনেক মজা করলাম, য়া কখনো কল্পনাও করিনায়। R সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে অামাদের বাংলাদেশেই এত সুন্দর ১টা জায়গা যা অামরা অনেক মিছ করে অাসছি। R এতে ধন্যবাদ জানায় বড় ভাই মেহেদী ও সব উদ্দোক্তাকে।

    1. আমাদের যাবার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো কিন্তু আপনারা যাবার পরে আর আমাদের তর সাইলো না। আসলেই অসাধারণ যায়গা। আবার যদি যায় তাহলে চুড়া পর্যন্ত উঠবো।

  2. আমাদের যাবার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো কিন্তু আপনারা যাবার পরে আর আমাদের তর সাইলো না। আসলেই অসাধারণ যায়গা। আবার যদি যায় তাহলে চুড়া পর্যন্ত উঠবো।

Leave a Reply to Saaneel IslamCancel reply

×
কপিরাইট © ২০০৬-২০২৪ সমকাল দর্পণ. সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েল টেকনোলজিস